প্রতিটি মানুষের জীবনে এমন মুহূর্ত আসে যখন সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জীবনের বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মনে হয়, “আমি ঠিক কি করব? কোন পথে যাব?” এই দ্বিধার সঙ্গে আমরা প্রায়ই সংগ্রাম করি। ভগবদ্গীতা আমাদের সেই সংকট থেকে মুক্তির পথ দেখায়। আজ আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ের সপ্তম শ্লোক নিয়ে আলোচনা করব, যেখানে অর্জুন তার ভ্রান্ত মনের কথা শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন।
শ্লোকটি ও তার অর্থ
কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসম্মূঢ়চেতাঃ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রুহি তন্মে
শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ ॥
অর্থ: “আমার স্বভাব এখন কার্পণ্যদোষে আক্রান্ত। আমি কোন পথ সঠিক তা বুঝতে পারছি না। তোমার কাছে জানতে চাই—যা আমার জন্য শ্রেয়, তা নির্দিষ্টভাবে বলো। আমি তোমার শিষ্য, আমি নিজেকে তোমার কাছে সমর্পণ করেছি, তুমি আমাকে শিক্ষা দাও।”
আপনার জীবনের সংকট ও এই শ্লোকের প্রাসঙ্গিকতা
আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে এমন পরিস্থিতি আসে, যখন আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হই। একদিকে সমাজের চাহিদা, অন্যদিকে আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা—এই সংঘাত থেকেই আমাদের মনে বিভ্রান্তি জন্মায়। অর্জুনও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এই বিভ্রান্তিতে পড়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না, যুদ্ধ করা উচিত নাকি পিছিয়ে আসা উচিত।
আপনার জীবনের উদাহরণ:
ধরুন, আপনি একটি ভালো চাকরি পেয়েছেন, কিন্তু সেই চাকরি আপনাকে পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আপনি কী করবেন? অর্জুনের মতো আপনার মনেও এই প্রশ্ন আসতে পারে, “কোন পথ শ্রেয়?” এই শ্লোকটি এখানে প্রাসঙ্গিক, কারণ এটি আপনাকে শেখায় কিভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
ধর্ম ও কর্তব্যের গুরুত্ব
ভগবদ্গীতা বলে, “ধর্মই জীবনের মূল।” এখানে ধর্ম মানে শুধু পূজা বা উপাসনা নয়, বরং জীবনের সেই নীতিগুলি যেগুলি আমাদের সঠিক পথে চালিত করে। শ্রীকৃষ্ণ বলেন:
“স্বধর্মে निधनং শ্রেয়ঃ, পরধর্মো ভয়াবহঃ।” (ভগবদ্গীতা ৩.৩৫)
অর্থাৎ, নিজের কর্তব্য পালন করাই শ্রেয়। অন্যের পথ অনুসরণ করা ভয়ংকর হতে পারে।
আপনার জীবনে যদি কোনো সংকট আসে, তবে প্রথমে আপনার কর্তব্য নির্ধারণ করুন।
কার্পণ্যদোষ কী?
এই শ্লোকে “কার্পণ্যদোষ” শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ হলো সংকীর্ণতা বা মানসিক দুর্বলতা। যখন আমরা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাই, তখন এই দোষ আমাদের গ্রাস করে।
উদাহরণ:
ধরুন, আপনার জীবনে এমন একটি সময় এসেছে যখন আপনাকে সত্য বলতে হবে। কিন্তু আপনি ভয়ে বা লোভে সেটা বলছেন না। এটি কার্পণ্যদোষ। শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শেখান, এই সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে।
শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা:
“ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ, নৈতত্ত্বয়্যুপপদ্যতে।” (ভগবদ্গীতা ২.৩)
অর্থাৎ, “হে পার্থ, দুর্বলতা তোমার জন্য উপযুক্ত নয়। সাহসের সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করো।”
বিভ্রান্তি থেকে মুক্তির উপায়
ভগবদ্গীতা বলে, বিভ্রান্তি তখনই দূর হয়, যখন আমরা নিজেকে শ্রীকৃষ্ণের কাছে সমর্পণ করি। অর্জুন বলেছিলেন, “আমি তোমার শিষ্য, আমাকে পথ দেখাও।” আমরাও যদি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হই, তবে আমাদের মনে শান্তি আসবে।
প্রথম ধাপ: নিজের সমস্যাটি চিন্তাভাবনা করে স্পষ্ট করুন।
দ্বিতীয় ধাপ: আপনার কর্তব্য বা দায়িত্ব নির্ধারণ করুন।
তৃতীয় ধাপ: সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ঈশ্বরের সাহায্য প্রার্থনা করুন।
গীতার শিক্ষা ও আপনার জীবন
- কর্মযোগ গ্রহণ করুন:
গীতা বলে, “কর্মই শ্রেয়।” যদি কোনো পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তবে কেবলমাত্র নিজের কাজের ওপর মনোনিবেশ করুন।
“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।” (ভগবদ্গীতা ২.৫০)
অর্থাৎ, কর্মে দক্ষতাই যোগ।
- সাহসিক হন:
যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভয় দূর করুন। ভগবদ্গীতা শেখায়, ভয় আমাদের শত্রু। - সত্য ও ন্যায়ের পথে চলুন:
আপনার সিদ্ধান্ত ন্যায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা বিচার করুন।
উপসংহার
আপনার জীবনে যেকোনো সংকট এলে ভগবদ্গীতার কাছে ফিরে যান। শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
“সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।” (ভগবদ্গীতা ১৮.৬৬)
অর্থাৎ, সব দ্বিধা ত্যাগ করে আমার শরণ নাও। আমি তোমাকে পথ দেখাব।