২য় অধ্যায় সাংখ্যযোগ শ্লোক ৮

২.৮ঃ মনের হতাশা ও দুঃখ

জীবনের প্রতিদিনের সমস্যাগুলি কখনো কখনো আমাদের এমন এক জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে মনে হয় সবকিছু অর্থহীন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা অনেকেই ভগবদ্গীতার আশ্রয় নিই। আজ আমরা ২য় অধ্যায়ের ৮ নম্বর শ্লোকের উপর আলোকপাত করব। শ্লোকটি বলছে:

“ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাদ্
যচ্ছোকমুচ্ছোষণমিন্দ্রিয়ানাম্।
অবাপ্য ভূমাবসপত্নমৃদ্ধং
রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্॥”

এই শ্লোকে অর্জুন তাঁর মনের গভীর হতাশা ও দুঃখ প্রকাশ করছেন। এমনকি তিনি বলতে চান, স্বর্গের রাজ্য বা পৃথিবীর সেরা সম্পদ পেলেও তাঁর এই শোক দূর হবে না।

কেন এই শ্লোকটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

আমার মতে, আপনার জীবনে এমন সময় নিশ্চয়ই এসেছে যখন সবকিছু আপনাকে অর্থহীন মনে হয়েছে। হয়তো কোনো প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, হয়তো চাকরিতে ব্যর্থ হয়েছেন, বা কোনো সম্পর্ক আপনাকে আঘাত করেছে। এই শ্লোক আমাদের শেখায় যে বাহ্যিক সাফল্য, ধনসম্পদ, বা ক্ষমতা কখনোই আমাদের অন্তরের দুঃখ মেটাতে পারে না।

আমি যদি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, একবার আমি জীবনের একটি বড় পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম। সে সময়ে মনে হয়েছিল, পৃথিবীর সমস্ত সুখ পেলেও এই শূন্যতা কখনো পূরণ হবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে ভগবদ্গীতার এই শ্লোকটি আমাকে বুঝিয়েছে, সত্যিকারের শান্তি বাহিরের জগতে নয়, নিজের ভেতরে খুঁজতে হয়।

ভগবদ্গীতার শিক্ষার আলোকে জীবন পরিবর্তন

ভগবদ্গীতা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জীবনের আসল উদ্দেশ্য হলো অন্তর্দৃষ্টির উন্নতি করা এবং নিজেদের সত্যিকারের সত্তাকে চিনতে পারা। এখানে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি, যা এই শ্লোকের অর্থ আরও স্পষ্ট করবে:

  • বাহ্যিক সম্পদ কখনোই শান্তি দিতে পারে না
    আমরা অনেক সময় মনে করি, বড় চাকরি বা প্রচুর টাকা পেলেই জীবনে সুখ আসবে। কিন্তু ভগবদ্গীতা বলে:
    “যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।”
    (তুমি কর্ম কর, কিন্তু তার ফলাফলের প্রতি আসক্তি রেখো না।)
    যখন আমরা এই নীতিতে জীবন যাপন শুরু করি, তখন বুঝতে পারি যে সত্যিকারের সুখ বাইরের কোনো বস্তুতে নেই।
  • আমাদের মন নিয়ন্ত্রণই আসল চ্যালেঞ্জ
    শোক বা হতাশা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের মনকে প্রশান্ত করতে হবে। গীতায় বলা হয়েছে:
    “উদ্ধরেত আত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েত্।”
    (তোমার আত্মাকে উত্থিত কর, নিজের মনকে পতনের দিকে ঠেলে দিও না।)
    আপনি যদি মনকে স্থির করতে পারেন, তাহলে বাহ্যিক দুঃখ আপনাকে ছুঁতে পারবে না।
  • পরিবারের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক
    অর্জুন তাঁর নিজস্ব পরিবার ও আত্মীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অক্ষম অনুভব করেছিলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন:
    “ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।”
    (আমি বা তুমি বা এই রাজারা কেউই কোনো সময় অস্তিত্বহীন ছিল না।)
    জীবনের সব সম্পর্ক অস্থায়ী। এটি মেনে নেওয়া আমাদের দুঃখ কমাতে সাহায্য করে।

কীভাবে এই শিক্ষাগুলি আপনার জীবনে প্রয়োগ করবেন?

  • মেডিটেশন করুন
    প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট নিজের মনের সঙ্গে সময় কাটান। নিজের অনুভূতিগুলোকে বোঝার চেষ্টা করুন।
  • কর্মে মনোনিবেশ করুন
    ফলাফলের চিন্তা বাদ দিয়ে কর্মে ফোকাস দিন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি একটি পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করেন, তাহলে ফলাফল নিয়ে চিন্তা না করে পড়ার অভিজ্ঞতায় মন দিন।
  • সংশোধনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলুন
    জীবন সবসময় আমাদের ইচ্ছামতো চলে না। যখন পরিস্থিতি খারাপ হয়, তখন তাকে শিক্ষার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করুন।
  • ভগবদ্গীতার শিক্ষার আলোকে সিদ্ধান্ত নিন
    প্রতিদিন গীতার কিছু শ্লোক পড়ুন এবং চিন্তা করুন যে এটি আপনার জীবনের কোন অংশে প্রাসঙ্গিক।

নিজেকে প্রশ্ন করুন

আমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য কী? আমরা কি শুধু বাহ্যিক সাফল্যের পেছনে ছুটে যাচ্ছি, নাকি সত্যিকারের শান্তি খুঁজে পাচ্ছি? ভগবদ্গীতার এই শ্লোক আমাদের শেখায় যে অন্তর্দৃষ্টির আলোকে জীবনের অর্থ খুঁজতে হবে।

আপনার কি কখনো মনে হয়েছে যে সমস্ত কিছু পাওয়ার পরেও কিছু একটা অপূর্ণ রয়ে গেছে? ভগবদ্গীতার শিক্ষা আপনার জীবন কীভাবে পরিবর্তন করেছে, তা শেয়ার করুন। এই ভাবনাগুলি আপনার জীবনে নতুন দিশা এনে দিতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top