২য় অধ্যায় সাংখ্যযোগ শ্লোক ৯

২.৯ঃ সংকল্প ও দ্বাহিত্ব

শ্লোক: ৯
সঞ্জয় উবাচ:
এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপঃ ।
ন য্যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তূঞ্চীং বভূব হ ॥৯॥

প্রিয় পাঠক, আমাদের জীবনে প্রতিদিনই আমরা নানা সংকট ও দোটানার মুখোমুখি হই। আপনি হয়তো ভাবছেন, “কীভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেব?” এই প্রশ্নের উত্তর আমরা ভগবদ্গীতার শিক্ষা থেকে পেতে পারি। আজ আমরা শ্লোক ৯-এর উপর ভিত্তি করে আলোচনা করব, যা জীবনের জটিল পরিস্থিতিতে আমাদের একটি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।

গীতার প্রসঙ্গ: সংকটের মুখে অর্জুন

শ্লোক ৯-এ সঞ্জয় বলেছেন, অর্জুন যখন হৃষীকেশ (ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)-কে জানালেন যে তিনি যুদ্ধ করবেন না, তখন তিনি এক গভীর দোটানায় পড়েছিলেন। এই দোটানা আমাদের জীবনে নতুন কিছু নয়। আমরা সকলেই কোনও না কোনও সময় নিজের দায়িত্ব পালনে ভয় পাই।

উদাহরণ হিসেবে ধরুন, আপনি যদি একজন শিক্ষার্থী হন, পরীক্ষার আগে ভয় ও সন্দেহ আপনাকে দমন করতে পারে। আপনার মনে হতে পারে, “আমি যদি ব্যর্থ হই?” ঠিক অর্জুনের মতো, আপনিও তখন নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হতে পারেন।

গীতার বার্তা: সংকল্প ও দায়িত্বের পথে দৃঢ় থাকা

শ্রীকৃষ্ণ এই পরিস্থিতিতে অর্জুনকে শেখালেন যে, জীবনে কখনোই দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেছিলেন:
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।”
(২.৪৭)
অর্থাৎ, আমাদের কাজ করে যেতে হবে, ফলাফলের চিন্তা না করে।

আপনার জীবনে এই শিক্ষাটি কেমনভাবে প্রয়োগ করতে পারেন? ধরুন, আপনি ব্যবসা করছেন এবং নতুন উদ্যোগে ঝুঁকি নেওয়ার সময় এসেছে। আপনি যদি ব্যর্থতার সম্ভাবনায় আটকে থাকেন, তবে সেই উদ্যোগে সফল হওয়া সম্ভব হবে না। শ্রীকৃষ্ণের এই উপদেশ আপনাকে সাহস জোগাতে পারে।

সংকটের সময়ে আধ্যাত্মিক শক্তি

ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে:
“বিধেয়া সর্বভূতেষু যঃ স্যাৎ স্নেহময়ঃ সুকৃতঃ।” (৫.২৫)
অর্থাৎ, যিনি সর্বভূতের প্রতি সদয় এবং নিজের কর্তব্যে অবিচল, তিনিই সঠিক পথে আছেন।

আমাদের জীবনে সমস্যাগুলি অনেক সময় বিশাল বলে মনে হয়। ধরুন, পরিবার ও কাজের ভারসাম্য রাখতে গিয়ে আপনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে, যদি আপনি আপনার কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকেন এবং আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করেন, তবে প্রতিকূল অবস্থায়ও আপনার মনোবল অটুট থাকবে।

উপলব্ধি ও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো

অর্জুন যখন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নিজের দায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন:
“অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে।” (২.১১)
অর্থাৎ, তুমি এমন বিষয়ে শোক করছো যা শোচনীয় নয়।

আমাদের জীবনের অনেক ঘটনাই এমন, যেগুলি আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখি। ধরুন, আপনি কোনও চাকরি হারিয়েছেন। প্রথমে এটি আপনার জীবনের শেষ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু যদি আপনি শ্রীকৃষ্ণের এই উপদেশকে মনে রাখেন, তবে বুঝতে পারবেন যে এটি হয়তো একটি নতুন সুযোগের শুরু।

আত্মসমর্পণের শিক্ষা

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বারবার বলেছেন আত্মসমর্পণের কথা।
“সর্বধর্মান্পরিত্যজ্য মামেরকম্ শরণং ব্রজ।” (১৮.৬৬)
অর্থাৎ, সমস্ত ধর্ম ছেড়ে আমার শরণাগত হও।

এই শিক্ষাটি আমাদের জীবনে এক গভীর বার্তা দেয়। আপনি যদি নিজের সমস্ত ভয় ও সংশয় ভগবানের হাতে তুলে দিতে পারেন, তবে আপনার মনের অস্থিরতা কমে যাবে। ধরুন, আপনি যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন, তবে নিজের আন্তরিক প্রচেষ্টা করার পর বাকি দায়িত্ব ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দিন।

জীবনকে বদলে দেওয়ার শিক্ষা

ভগবদ্গীতা আমাদের শিখিয়েছে কেবলমাত্র আমাদের কাজের উপর মনোযোগ দিতে এবং ভয় না পেতে। একবার আপনি নিজের জীবনকে এই শিক্ষার আলোকে দেখলে, বুঝবেন যে সংকট ও সমস্যা কেবল একটি সুযোগ।

আমার জীবনের একটি ঘটনা এখানে শেয়ার করছি। একবার আমি একটি বড় কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। কাজটি ছিল খুবই কঠিন, এবং আমার মনে ভয় কাজ করছিল। কিন্তু গীতার শিক্ষার উপর ভিত্তি করে আমি নিজেকে বলেছিলাম, “আমি শুধু আমার কাজ করব, ফলাফলের চিন্তা করব না।” অবশেষে, আমি সাফল্য অর্জন করলাম এবং সেই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল।

প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পথ

ভগবদ্গীতা কেবল একটি ধর্মগ্রন্থ নয়; এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি সমস্যার একটি গাইড। অর্জুনের মতো, আমাদেরও জীবনে সংকট আসবে। কিন্তু আপনি কীভাবে সেই সংকটের মোকাবিলা করবেন?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top